ঢাকার সাভার উপজেলায় শহীদ ছায়াদ মাহমুদ খান: "মৃত্যুর তারিখ, বয়স, ঘটনাস্থল সবই ভুল, আদালতে ভুয়া তথ্য দিয়ে মামলা" আমার সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে আমি নিজেই সাভার থানায় মামলা করেছি, ট্রাইবুনালে দিয়েছি অভিযোগ। যাকে চিনি না জানি না, সে কেন আমার শহীদ সন্তানকে ভিকটিম বানিয়ে আদালতে অভিযোগ দিবে। যে অভিযোগে মৃত্যুর তারিখ সময় ও ঘটনাস্থল সবই মিথ্যা। এটা মনে হচ্ছে একটি ষড়যন্ত্র। এভাবেই বলছিলেন জুলাই আগষ্ট ছাত্র জনতা অভ্যুত্থানে শহীদ ছায়াদ মাহমুদ খানের বাবা বাহাদুর খা।
সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানাধীন ধল্লা এলকায় সরেজমিনে যায় নিউজটুডে। সেখানেই তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, গত বছর জুলাইয়ের ২০ তারিখ বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সাভার নিউ মার্কেটের দক্ষিণ পূর্ব দিকের চাপাইন সড়কে গুলিবিদ্ধ হন ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছায়াদ মাহমুদ খান। পরে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন। ছায়াদ মাহমুদ খান জাবাল-ই-নুর দাখিল মাদ্রাসা লেখা পড়া করতেন। এরপরই তিনি গত বছর ৮ সেপ্টেম্বর সাভার মডেল থানায় ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যেখানে শেখ হাসিনাসহ ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ২০/৫০ জনকে আসামি করা হয়।
এক বছর পর রহস্যময় আরেক মামলা। এদিকে দীর্ঘ এক বছর পর শহীদ ছায়াদ মাহমুদ খানকে ভিকটিম উল্লেখ করে ঢাকার বিজ্ঞ জুটিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন ঢাকা জেলার সাভার থানাধীন শাহীবাগ এলাকার সোলায়মান মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম (৫৬)। যেখানে ছায়াদ মাহমুদ খান সঙ্গে তার সম্পর্ক কিছু উল্লেখ না থাকলেও তিনি নিজেকে দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করেন। যেখানে ২৫২ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয় ২০০/৩০০ জনকে। তবে সে মামলায় ঘটনাস্থল দেখানো হয় আশুলিয়া থানার সামনে। ঘটনার তারিখ দেখানো হয় গত বছর ১৯ জুলাই। শহীদ ছায়াদ মাহমুদ খানের বয়স ১২ বছর হলেও আদালতের মামলায় দেখানো হয় ২৬ বছর। তবে বাবার নাম আর স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় ছিল মিল। যদিও আদালত মামলাটির তদন্তের নির্দেশ দেন আশুলিয়া থানা পুলিশকে।
বয়সের ব্যবধান দেখে দুইটি মামলার ভিকটিম এক কিনা এমন প্রশ্ন আসে সামনে, এ প্রশ্ন খুজতে যাওয়া হয় মামলায় উল্লেখ করা ভিকটিমের বাড়ী মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার ধল্লা খানপাড়া গ্রামে।
কথা হয় সেখানকার স্থানীয় আল-হাসান মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, এ গ্রামে শুধু নয় পুরো সিংগাইর থানায় জুলাই অভ্যুত্থানে একজনই শহীদ হয়েছে। তিনি হলেন বাহাদুর খানের ১২ বছরের ছেলে ছায়াদ মাহমুদ খান। যে শহীদ হয়েছে সাভারে। যাকে কবরস্থ করা হয়েছে ধল্লা কেন্দ্রীয় কবরস্থানে। এ এলাকার আর কেউই শহীদ হয়নি। এমন একই তথ্য দেন এলাকার আরো বেশ কয়েকজন।
আদালতের মামলায় উল্লেখ করা ঘটনাস্থল আশুলিয়া থানার সামনে গিয়ে স্থানীয়দের কাছে জানতে চেয়েছিলাম গতবছর ১৯ জুলাই কোন গুলাগুলি ঘটনা ঘটেছে কিনা? কেউই এর সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা রিফাত আহমেদ ইমন জানান, আশুলিয়া থানায় বর্বর ঘটনা ঘটে ৫ আগস্ট। ১৯ জুলাই তারিখে আশুলিয়া থানার সামনে কোন গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। হলে জানা থাকতো।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেকর্ড বইয়ের বরাদ দিয়ে ম্যানাজার ইউসুফ আলী বলেন, সাভারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন ১২ বছরের ছেলে ছায়াদ মাহমুদ খান। তার গ্রামের বাড়ী মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার ধল্লা খানপাড়া গ্রামে। সরকারী গেজেটও ১২০ নম্বর তালিকায়ও রয়েছে ছায়াদ মাহমুদ খানের নাম। যার মেডিকেল কেস নম্বর ১১৮৫৩।
যাকে চিনি না, সে কীভাবে আমার সন্তানের হত্যা মামলার বাদী" প্রশ্ন শহীদ পিতার
আদালতে মামলা দায়ের করা বাদী রফিকুল ইসলাম কে, এমন প্রশ্ন করতে শহীদ ছায়াদ মাহমুদ খানের বাবা বাহাদুর খান বলেন, আদালতে মামলায় যিনি বাদী হয়েছেন তাকে তিনি চেনেনই না। এটিকে তিনি ষড়যন্ত্র মনে করছেন। মামলার আসামী সংখ্যা ও তাদের ঠিকানা দেখে মনে হচ্ছে অসৎ উদ্দেশ্য করা৷
এ বিষয়ে আদালতের মামলায় উল্লেখ করা বাদী রফিকুল ইসলামের মোবাইল নম্বরের ফোন দিলে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়।
আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল হান্নান বলেন, আদালতের একটি মামলা তদন্ত এসেছে। আদালত প্রতিবেদন চেয়েছেন। আমরা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করবো। আশুলিয়া থানায় ছায়াদ মাহমুদ খানকে ভিকটিম দেখিয়ে কোন মামলা দায়ের হয়নি। তবে সাভার মডেল থানায় শহীদ মাহমুদ খানের বাবা বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যা সাভার মডেল থানা পুলিশ তদন্ত করছেন।
উঠছে প্রশ্ন কারা করছে এসব ভুয়া মামলা। আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার ইমাম হাসান ভূঁইয়া বলেন, একজন শহীদের নাম, পরিচয়, বয়স ও ঘটনার বিবরণ বিকৃত করে আদালতে মিথ্যা মামলা দায়ের করা ভয়াবহ অপরাধ। এতে শুধু শহীদের সম্মান নষ্ট হয় না, নিরীহ মানুষ আইনি হয়রানির শিকার হয়। পুলিশ প্রতিবেদনে বিষয়টি স্পষ্ট না করলে লম্বা সময় ভোগান্তি পোহাবে ভূয়া মামলার আসামীরা।