অবরোধে পেট্রোল বোমা হামলা-বাসে আগুন, জনমনে আতঙ্ক

বিএনপি-জামায়াতের ডাকা দ্বিতীয় দফার অবরোধের প্রথম দিনে দুই জায়গায় পেট্রোল বোমা হামলার খবর এসেছে। এরমধ্যে প্রথম হামলা হয়েছে রাজধানীর বনশ্রীতে। দ্বিতীয়টি হয়েছে সিলেটের পারাইরচক জলকরকান্দি এলাকায়। রাজনৈতিক আন্দোলন ঘিরে নতুন করে পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনায় জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
তারা বলছেন, ২০১৩-১৪-১৫ সালে সারা দেশে ব্যাপক পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এর শিকার হয়েছিল সাধারণ মানুষ। হরতাল কিংবা অবরোধ-যাইহোক, কর্মজীবি মানুষকে আতঙ্ক মাথায় নিয়ে ছুটতে হয় কর্মস্থলে। রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে নির্মমতার শিকার কেন সাধারণ মানুষ হবে?
এদিকে বিএনপি-জামায়াতের দ্বিতীয় দফা ডাকা অবরোধের প্রথমদিন রোববার ঢাকায় চার বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সকাল ৭টার দিকে রাজধানীর বনশ্রীর মেরাদিয়া বাঁশপট্টি এলাকায় অছিম পরিবহন নামে একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে রমজান পরিবহনের বাসের চালক দগ্ধ হন। বিকেলে রাজধানীর মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বাংলামোটরে একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। রূপায়ন টাওয়ারের সামনে বাসটিতে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। এ ছাড়াও মিরপুরে শিকড় পরিবহনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। সন্ধ্যা ৭টার দিকে পল্লবী এলাকায় সেতারা কনভেনশন সেন্টারের সামনে ওই বাসে আগুন দেওয়া হয়।
এর সকালে খিলগাঁও থানার বনশ্রী এলাকায় অছিম পরিবহন নামে একটি বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মো. সবুজ (৩০) নামে এক গাড়িচালক দগ্ধ হন। তিনি রমজান পরিবহনের চালক ছিলেন। এছাড়া দুপুরে উত্তরা হাউজবিল্ডিং এলাকায় পুলিশের টহল গাড়িকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ওই ককটেল বিস্ফোরিত হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই মাহবুব আলীসহ তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। এর বাইরে ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন স্থানে অবরোধ সমর্থনকারীদের বিক্ষোভ-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
শনিবার রাতে রাজধানীর গুলিস্তানে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ওইদিন সন্ধ্যায় রাজধানীর আরও তিনটি এলাকায় বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে রাজধানীর নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড ও সায়েদাবাদ জনপথের মোড়ে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
বিএনপির ডাকা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শনিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রোববার সকাল সাড়ে ৬টা রাজধানীসহ সারাদেশে ১২টি স্থানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে রাজধানীতে সাত জায়গায় আগুন লাগানো হয়েছে। ১০টি বাস, একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রোববার সকালে এসব তথ্য জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম।
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা জানান, শনিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রোববার সকাল ৬টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত অবরোধের আগের রাতে ১২টি স্থান থেকে আগুনের সংবাদ পাওয়া গেছে। ঢাকা শহরে সাতটি, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর দুটি, সিরাজগঞ্জে একটি, বরিশালের চরফ্যাশনে একটি, রংপুরের পীরগঞ্জে একটি ঘটনা ঘটে। তিনি আরও জানান, ঢাকাসহ সারাদেশে ৯টি বাসে আগুন, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বাদলপুরে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসে আগুন এবং একটি জায়গায় গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ারে আগুন দেওয়া হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছর থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করেছে রাজপথের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে গত ২৯ অক্টোবর হরতাল ও ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত অবরোধ পালনের মাধ্যমে সেই আন্দোলনের ধারায় ফিরেছে দলটি। দ্বিতীয় ধাপে রবিবার (৫ নভেম্বর) ও সোমবার (৬ নভেম্বর) সারা দেশে দলটি অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে।
বিএনপির প্রথম ধাপের অবরোধের সময় থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণসহ আগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের খবর পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গা পেট্রোল বোমা উদ্ধারের খবর দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই বোমাসহ অনেকে আটকও হয়েছেন।
বিএনপির অবরোধের দ্বিতীয় ধাপের প্রথম দিনেই দেশের দুই জায়গায় পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। রবিবার সকাল ৭টার দিকে রাজধানীর বনশ্রীতে অছিম পরিবহনের একটি বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। আগুন লাগা মাত্র চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের খাদে ফেলে দেয় বাসটি। এতে বাসচালক সবুজ দগ্ধ হয়েছেন।
একইদিন সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের পারাইরচক জলকরকান্দি এলাকায় একটি খাদ্যপণ্যবাহী পিকআপ ভ্যানে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে আগুন ধরে গাড়ির সামনের অংশ পুড়ে যায়। এ সময় পুলিশ এক পিকেটারকে আটক করে।
রাজধানীর যাত্রবাড়ি এলাকার বাসিন্দা রাসেল মাহমুদের কর্মস্থল কুড়িল বিশ্বরোড। নিয়মিত তাকে গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হয়। রাসেল বলেন, বাসে উঠার সময়ই মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক থাকে। তারপর তো কখন পৌঁছাব, ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারব কি না, এসব চিন্তা তো থাকেই। যাত্রীদের নিরাপত্তায় বাসচালক ও সহকারীদের সতর্ক থাকতে দেখেছেন রাসেল। তিনি বলেন, তারা যাত্রীদের বাসের জানালা খোলা রাখতে দেন না। এখন তো বাসের জানালা দিয়েই আগুন দেওয়া হয়।
মিরপুর-১ নম্বর থেকে কারওয়ান বাজার এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করে কর্মস্থলে যোগ দেন গাজী কাইয়ুম। তিনি মনে করেন, বাসে আগুন দেওয়া বা পেট্রোল বোমা হামলা বন্ধ করার জন্য সাধারণ মানুষের সচেতনতা বেশি দরকার। মানুষ সচেতন থাকলেও এ ধরনের ঘটনা সহজে ঘটানো সম্ভব হবে না। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে নির্মমতার শিকার কেন সাধারণ মানুষ হবে , এমন প্রশ্নও রেখেছেন তিনি।
কায়ুইম বলেন, আমরা তো চাকরি করি ভাই। অফিস না গেলে তো বেতন কাটবে কর্তৃপক্ষ। সংসার চালানো তখন দায় হয়ে যাবে। বাসা থেকে না বের হয়ে কোনো উপায় নেই। আজ শুনলাম বাসের ভেতর নাকি পেট্রোল বোমা মারছে। সেই ৬-৭ বছর এরকমটা শুনতাম প্রতিদিন। আমার চেয়ে পরিবারের অন্য সদস্যরা বেশি চিন্তিত থাকে, ঠিকভাবে বাসায় ফিরতে পারব কি না।
এদিকে অবরোধের মধ্যে চট্টগ্রামে বিএনপির ডাকা হরতালের শুরুতে পতেঙ্গা এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। রোববার ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে পতেঙ্গা থানার কাটগড়ের গুমপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে।
পতেঙ্গা থানা পুলিশ জানিয়েছে, বাসটি পোশাক শ্রমিকদের বহন করার জন্য ওই এলাকায় অবস্থান করছিল।
দেশব্যাপী বিএনপি-জামায়াতের ডাকা দুইদিনের অবরোধে নগরীতে স্বাভাবিকের তুলনায় কম গণপরিবহন চলাচল করে। নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে করে দেখা গেছে- রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, টেম্পু, ভাড়ায় চালিত রাইড, মিনিবাস চলাচল করলেও স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় সংখ্যা ছিল কম। অফিসগামী যাত্রীরদের বাড়তি ভাড়া দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে যেতে দেখা গেছে।
এদিকে বিএনপির এই অবরোধ ঘিরে রাজধানীতে ব্যাপক সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য লক্ষ্য করা গেছে। রোববার সকাল থেকে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনেকটা ফাঁকা দেখা গেছে। এখনও কেন্দ্র তালাবদ্ধ। সেখানে দলবেঁধে পুলিশ অবস্থান করছে। এছাড়া ঢাকার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে টহল দিতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
নয়াপল্টনে সরেজমিনে দেখা গেছে, বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় দুই ইউনিটে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশ সদস্যরা। সেখানে ব্যারিকেডও রাখা হয়েছে। সর্বাত্মক অবরোধে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে আরও ১০ প্লাটুন।