দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রে পালাবদলের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। এক সময় যেসব সরকার একদশক বা তারও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিল, একে একে সেই সব সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে জনগণ, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তরুণ প্রজন্ম- বিশেষ করে জেনারেশন জেড। এই প্রজন্মের স্লোগান, প্রতিবাদ, এবং রাস্তায় নামা এখন আর আলাদা কোনো দেশের ঘটনা নয়; বরং এটি একটি আঞ্চলিক ধারাবাহিকতায় রূপ নিয়েছে।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নেপাল—তিন দেশেই শাসনব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটেছে। অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ এবং তরুণ সমাজের হতাশা মিলেমিশে এসব দেশে শাসকদের পতনের পথ তৈরি করেছে।
শ্রীলঙ্কা: অর্থনৈতিক সংকটে রাজাপাকসের বিদায়
২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়, শ্রীলঙ্কা চরম খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ সংকটে পড়ে। পর্যটন খাতের ধস, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, দুর্নীতি ও অদূরদর্শী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার মুখে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ ‘গোটা গো হোম’ স্লোগানে রাস্তায় নামে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। শেষপর্যন্ত তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন এবং পদত্যাগ করেন।
বাংলাদেশ: কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতন
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলন দমনে পুলিশের গুলি ও সহিংসতায় উত্তেজনা আরও বাড়ে। দ্রুতই এই আন্দোলন শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে রূপ নেয়। সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ৫ আগস্ট হাসিনা পদত্যাগ করে ভারত চলে যান। পরবর্তীতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
নেপাল: ‘জেন জি বিদ্রোহ’ ও ওলির পতন
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। স্কুলপোশাক পরা শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হয় এক ব্যতিক্রমী আন্দোলন, যা আন্তর্জাতিকভাবে ‘জেন জি বিদ্রোহ’ নামে পরিচিতি পায়। সরকারি দমননীতি ব্যর্থ হলে একে একে মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেন, এবং অবশেষে প্রধানমন্ত্রী ওলিও পদত্যাগে বাধ্য হন।
ডমিনো ইফেক্ট: এরপর কার পালা?
তিনটি দেশের ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট একটি মিল রয়েছে- দীর্ঘদিনের শাসন, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি এবং তরুণদের ক্ষোভ। তিনটি ঘটনাই ঘটে জুলাই, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে- মাসব্যাপী ধারাবাহিকতায়। এটি নিছক কাকতালীয় নাকি পরিকল্পিত পরিবর্তনের ইঙ্গিত—সে প্রশ্ন এখন উঠছে।
পরবর্তী দেশ হিসেবে নজরে রয়েছে পাকিস্তান, মিয়ানমার ও মালদ্বীপ। পাকিস্তানে চলছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, মিয়ানমারে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ চলছে, আর মালদ্বীপে ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক নির্ভরতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
তরুণদের কণ্ঠস্বর: উপেক্ষার ফল ভয়াবহ হতে পারে
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাস ইঙ্গিত দেয়- তরুণদের উপেক্ষা করলে যে কোনো সরকারকেই চরম মূল্য দিতে হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন তাদের সংগঠিত করছে, তেমনি সেই মাধ্যম নিষিদ্ধ করা হলে তারা রাস্তায় নেমে আসতে দ্বিধা করছে না।
সমাপ্তি নয়, শুরু হতে পারে নতুন অধ্যায়ের
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে জেনারেশন জেড। অক্টোবর মাস সামনে, অনেকেরই প্রশ্ন- এই ডমিনো ইফেক্ট কি অব্যাহত থাকবে? আর যদি থাকে, তবে পরবর্তী শাসকের পতনের খবর কি আসছে আরেকটি দেশের দিক থেকে?
উত্তর সময়ই দেবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত- এই প্রজন্মের আওয়াজ থামিয়ে রাখা আর সম্ভব নয়।