
চট্টগ্রাম–কাপ্তাই আঞ্চলিক সড়কের পাশে হাটহাজারী থানার মদুনাঘাট পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র। এর ঠিক বিপরীতে রাস্তার ধারে পড়ে আছে গুলিতে ঝাঁজরা একটি প্রাইভেটকার যে গাড়িতেই আগের দিন দিবালোকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমকে। গাড়ির চারপাশে ভিড় করছে কৌতূহলী মানুষ; কেউ ছবি তুলছে, কেউ আবার ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। গাড়ির সামনের কাচ ও বনেটে চারটি গুলির চিহ্ন, আর হাকিম যেখানে বসেছিলেন, সেই দরজার কাচে অন্তত ১২টি গুলির দাগ। চালকের পাশের দরজায় দুটি এবং গাড়ির শরীরে আরও দুটি গুলির ছিদ্র দেখা গেছে। প্রকাশ্য মহাসড়কে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটলেও এখনো শনাক্ত হয়নি খুনিরা।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সন্দেহ রাউজানের তিনটি চিহ্নিত বাহিনীর দিকে ফজল হক, রায়হান ও জসিম বাহিনী। এর মধ্যে ফজল হক পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, যিনি বিদেশে বসে তার বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেন। রায়হানের বিরুদ্ধে গত ১৪ মাসে অন্তত ৯টি হত্যার অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে বালুমহাল ও পাহাড়ি মাটি কাটার দখল নিয়ে একাধিক অভিযোগ ওঠে। আবদুল হাকিম হত্যা মামলায় এই বাহিনীগুলোর সম্পৃক্ততার আশঙ্কায় ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাউজান এলাকা।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা পুলিশের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গাড়িটি সেন্সরযুক্ত ছিল বলে গুলি লাগার পরই সেটি থেমে যায়। নয়তো হয়তো তারা পালিয়ে বাঁচতে পারতেন। তিনি জানান, হাকিমের শরীরে ১০টি গুলি লেগেছে, আর চালক মোহাম্মদ ইসমাইলের শরীরে দুটি গুলি লাগে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে রাউজানে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত ১৪ মাসে এখানে ১৬ জনকে খুন করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৩ জনই বিএনপি সংশ্লিষ্ট। মঙ্গলবার নিহত ব্যবসায়ী ও বিএনপিকর্মী আবদুল হাকিম সেই তালিকার সর্বশেষ নাম। স্থানীয়দের ভাষ্য, এলাকায় বিএনপির দুই গ্রুপের আধিপত্যের লড়াইয়ের পাশাপাশি বালু ও মাটি কাটা নিয়ন্ত্রণ নিয়েও চলছে সংঘাত যা এই হত্যার পেছনের মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
একসময় সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আবদুল হাকিম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। তবে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি ঘনিষ্ঠ হন রাউজানের বিরোধপূর্ণ বিএনপি রাজনীতির অন্যতম নেতৃত্বাধীন ব্যক্তি, ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে স্থগিত হওয়া গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে। এ বছরের শুরুতে তিনি দলের সদস্যপদও নবায়ন করেন।
তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ভিন্ন সুর শোনা যায়। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আবদুল হাকিম বিএনপির কেউ নন, হত্যাকারীরাও দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। এই অবস্থানে ক্ষোভ প্রকাশ করে গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারীরা অভিযোগ তুলেছেন, গোলাম আকবর খোন্দকারের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ বিষয়টি ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
হাকিমের জানাজায় উপস্থিত ছিলেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি বলেন, আবদুল হাকিম আমাদের কর্মী ছিলেন। দলের সব কর্মকাণ্ডে তিনি সক্রিয় ছিলেন। আমার নিঃশ্বাস থাকতে আমি এই হত্যার প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ব।
অন্যদিকে, বিএনপি নেতা গোলাম আকবর খোন্দকার এক বিবৃতিতে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সান্তু বলেন, আমরা সিসিটিভি ফুটেজসহ নানা তথ্য বিশ্লেষণ করছি। আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের জন্য কাজ চলছে।