
ফ্রান্সের রাজনীতিতে ফের উত্তেজনা ও অস্থিরতার ছায়া। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এবং নিজের মন্ত্রিসভা ঘোষণা করার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই পদত্যাগ করলেন দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী সেবাস্তিয়ান লেকোর্নু। সোমবার (৪ অক্টোবর) এক সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী লেকোর্নু পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তা গ্রহণ করেছেন।
প্রায় এক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন লেকোর্নু। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক সংকট ও অর্থনৈতিক চাপে পড়েন তিনি। বাজেট ঘাটতিতে বিপর্যস্ত ফ্রান্সের বিভক্ত সংসদে বাজেট পাস করানো তার জন্য হয়ে ওঠে বড় চ্যালেঞ্জ। সংসদের ভেতরে-বাইরে বিরোধী দলগুলোর চরম বিরোধিতায় কার্যকর প্রশাসন পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
রোববার রাতে লেকোর্নু নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর, সোমবার সকালে, তিনি হঠাৎ করেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে ফ্রান্সের ইতিহাসে তার সরকার অন্যতম স্বল্পস্থায়ী সরকারে পরিণত হয়।
নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য তালিকা প্রকাশের পর থেকেই তা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। অনেকে অভিযোগ করেন, লেকোর্নু তার অজনপ্রিয় পূর্বসূরি ফ্রাঁসোয়া বাইরুর নীতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিলেও মন্ত্রিসভায় পুরনো ও বিতর্কিত মুখদেরই প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলে জনআস্থা আরও কমে যায় এবং তার ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়তে থাকে।
পদত্যাগের আগে সাংবাদিকদের উদ্দেশে লেকোর্নু বলেন,আমি সমঝোতার পথ খুঁজে বের করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিটি দল চাচ্ছিল অন্যরা যেন তাদের পুরো কর্মসূচি মেনে নেয়। এই অবস্থায় কোনও অগ্রগতি সম্ভব ছিল না।
তার এই বক্তব্যে স্পষ্ট, সংসদে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ একপ্রকার নেই বললেই চলে।
২০২৪ সালের আগাম নির্বাচনের পর থেকেই ফরাসি রাজনীতি চরম মেরুকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে অতিদক্ষিণপন্থি শক্তি, অন্যদিকে অতিবামপন্থিরা, এই দুই মেরুর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে গভীর সঙ্কটে পড়েছে দেশটির রাজনৈতিক অবকাঠামো। এই অস্থির প্রেক্ষাপটে সেবাস্তিয়ান লেকোর্নু ছিলেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর মাত্র দুই বছরে পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী। তার আকস্মিক পদত্যাগ প্রেসিডেন্টের নেতৃত্ব নিয়েও বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
বিরোধীদলগুলোর ভাষ্য, সরকারপ্রধানদের এভাবে বারবার বদল প্রমাণ করে যে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ কার্যত নিজের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন।
লেকোর্নুর পদত্যাগের তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতেও। খবর প্রকাশের পরপরই প্যারিস শেয়ারবাজারের প্রধান সূচক দুই শতাংশের বেশি হ্রাস পায়। বাজেট সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নেতৃত্বের অনিশ্চয়তা, সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি ফ্রান্স এখন কার্যত রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে। সংসদে কোনও দলই এককভাবে সরকার গঠনে সক্ষম নয়, প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তাও দিন দিন কমছে। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে তা শুধু ফ্রান্স নয়, গোটা ইউরোপীয় অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।